বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০১০
Wait for me - Konstantin Simonov
মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১০
বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ
মহাদেব সাহা
আবৃত্তি রুদ্রাক্ষর
আমি হয়তো কোনোদিন কারো বুকে
জাগাতে পারিনি ভালোবাসা,
ঢালতে পারিনি কোনো বন্ধুত্বের
শিকড়ে একটু জল-
ফোটাতে পারিনি কারো একটিও আবেগের ফুল
আমি তাই অন্যের বন্ধুকে চিরদিন বন্ধু বলেছি;
আমার হয়তো কোনো প্রেমিকা ছিলো না,
বন্ধু ছিলো না,
ঘরবাড়ি, বংশপরিচয় কিচ্ছু ছিলো না,
আমি ভাসমান শ্যাওলা ছিলাম,
শুধু স্বপ্ন ছিলাম;
কারো প্রেমিকাকে গোপনে বুকের মধ্যে
এভাবে প্রেমিকা ভেবে,
কারো সুখকে এভাবে বুকের মধ্যে
নিজের অনন্ত সুখ ভেবে,
আমি আজো বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ।
তোমাদের সকলের উষ্ণ ভালোবাসা, তোমাদের
সকলের প্রেম
আমি সারি সারি চারাগাছের মতন আমার বুকে
রোপণ করেছি,
একাকী সেই প্রেমের শিকড়ে আমি
ঢেলেছি অজস্র জলধারা।
সকলের বুকের মধ্যেই একেকজন নারী আছে,
প্রেম আছে,
নিসর্গ-সৌন্দর্য আছে,
অশ্রুবিন্দু আছে
আমি সেই অশ্রু, প্রেম, ও নারী ও স্বপ্নের জন্যে
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগেছি;
সকলের বুকের মধ্যে যেসব শহরতলী আছে,
সমুদ্রবন্দর আছে
সাঁকো ও সুড়ঙ্গ আছে, ঘরবাড়ি
আছে
একেকটি প্রেমিকা আছে, প্রিয় বন্ধু আছে,
ভালোবাসার প্রিয় মুখ আছে
সকলের বুকের মধ্যে স্বপ্নের সমুদ্রপোত আছে,
অপার্থিব ডালপালা আছে।
আমি সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা, সেই স্বপ্ন
সেই রূপকথার
জীবন্তমানুষ হয়ে আছি;
আমি সেই স্বপ্নকথা হয়ে আছি, তোমাদের
প্রেম হয়ে আছি,
তোমাদের স্বপ্নের মধ্যে ভালোবাসা হয়ে আছি
আমি হয়ে আছি সেই রূপকথার স্বপ্নমানুষ।
|
রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০০৯
ছাড়পত্র
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক'রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।।
কেউ কথা রাখেনি
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।
মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?
একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!
শুধু তোমার জন্য
নির্মলেন্দু গুণ
কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।‘
আর অমি এ-কী শুনলাম
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।
তোমার চোখ এতো লাল কেন
নির্মলেন্দু গুণ
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।
আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক ।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : 'তোমার চোখ এতো লাল কেন ?'