আমার আপাকে নিয়ে আমার ছোট মামার একটা লেখা।
ছোট ভাই স্বপ্ন দেখে, একমাত্র বড় বোন উচ্চ শিক্ষা নিতে বিদেশ যাবে। মনে মনে বিমান বন্দরে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি পর্যন্ত নিয়ে ফেলেছে। বাবা মায়ের স্বপ্ন, একমাত্র মেয়ে অন্তস্বত্তা, কোল আলো করে আসবে আপনজন। আর তাকে নিয়ে কাটিয়ে দিবে জীবণের বাকী দিনগুলো। এই যদি হয় একজন মানুষকে ঘিরে তার আপনজনের স্বপ্ন, তাহলে সেই মানুষটির স্বপ্ন কি হতে পারে তা আমরা কম বেশী অনুমান করতে পারি।
জি, আমি সেই মেয়েটির কথাই বলছি, যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শত শত প্রতিকুলতার সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছিল। আশা ছিল আরও ভাল কিছু করার। কিন্তু যে মেয়েটি শত প্রতিকুলতার সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছিল, সেই মেয়েটিই একটি মাত্র প্রতিকুলতার কাছে হেরে গিয়ে আজ আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে আছে। আর সে প্রতিকুলতা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রশাসনের দ্বায়ীত্বহীনতা আর অব্যাবস্তাপনা। হ্যা, গত বছর এই দিনে অফিসে যেতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন দৈনিক জনকন্ঠের প্রশাসনিক কর্মকর্তা অন্তস্বত্তা সহেলী আক্তার সম্পা আর তার স্বামী শাহীন। এক নিমিষে একটি পরিবার তার আপন জনের কাছ থেকে হারিয়ে গেল। তাদেরকে চির বিদায়ের জন্য সবাই যখন এক হল তখন সম্পার ছোট ভাই, জনকন্ঠের আই টি ম্যানেজার মারুফ হোসেন পারভেজ আমাকে বললো, “মামা,আপুকে এ কোথায় বিদায় জানাতে এলাম। স্বপ্ন তো ছিল উচ্চ শিক্ষা নিতে বিদেশ যাওয়ার জন্য বিমান বন্দরে বিদায় জানাবো।”
বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় যে ভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে তার জন্য প্রশাসনের দ্বায়ীত্বহীনতা অনেকাংশে দ্বায়ী। অপ্রত্যাশিত বিদায় আমাদেরকে মানতে হয়। যেমন, সেই জাপানিজ ছেলেটার কথাই ধরুন। ক্লাশরুম থেকে দেখছিল তার বাবা গাড়ীতে করে তাকে নিতে আসছে। এক পলকের মধ্যে সে দেখল, সুনামির পানি গাড়ী সহ তার বাবাকে দুমড়ে মুচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর ওদিকে সুনামির পানি তাদের বাড়ী সহ তার মা ও বোন কে ভাসিয়ে নিয়ে গিছে। এরকম পরিস্থিতি কেউই মেনে নিতে পারেনা। কিন্তু প্রকৃতির উপর মানুষ বড় অসহায়। তাই মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়। কিন্তু মানুষের সৃষ্টি পরিস্থিতি যদি আপন জনকে কেড়ে নেয়, তাহলে মেনে নিতে আরও কঠিন। আর প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই বলা চলে।
যেসব পরিবার সড়ক দুর্ঘটনায় আপন জনকে হারিয়ে সর্বশান্ত, তাদের নিরব কান্না প্রশাসন শুনতে পায়না। আর আমরা সংবাদপত্রের পাঠকগণ, প্রতিদিন নিত্য নতুন অঘটনার মুখোমুখি হয়ে ভুলে যায় গত দিনের ঘটনা। কিন্তু যাদের বুক খালি হয় তারাই শুধু কবির সেই মহান বানীর মর্ম বোঝে। “কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে...।”
গত একটি বছর পারভেজের মুখে নেই কোন হাসি, নেই কোন নতুন স্বপ্ন। আছে শুধু দীর্ঘনিশ্বাস। আর আছে বোনের রেখে যাওয়া জিনিস গুলোর প্রতি অঢেল ভালবাসা। এই ভালবাসাটুকু নিয়েই যেন তার জীবণের পথ চলা। আর সম্পার মায়ের কথা শুনতে চান? কিন্তু পাঠকগণ, আপনারা শুনতে চেলেও আমার শোনানোর কোন ক্ষমতা নেই। কারন, সম্পার মায়ের কান্নার শব্দ যে কোন বড় লেখকের কলমকে কাপিয়ে দিবে। আর চোখের পানিতে পরনের কাপড় যে কতবার ভিজে আবার শুকিয়ে যায় তার হিসাব আমার মত মানুষের করা সম্ভব না। আর বাংলাদেশের শত হাজার মায়ের চোখের পানি এক করলে হয়ত একটা সাগর হয়ে যেত। এই পানিতে বাংলাদেশের শত হাজার মায়ের পরনের কাপড় বার বার ভিজলেও, ভিজে না আমাদের প্রশাসনের মন। প্রশাসন একটু সচেতন, একটু দ্বায়ীত্ববান হলে সড়ক দুর্ঘটনা কিভাবে কমে যেত তা আমি জাপানকে দেখে জাপানে বসেই বুঝেছি। তাই শত হাজার মায়ের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে আমার একটিই মাত্র আবেদন, আপনারা একটু দ্বায়ীত্ত্ববান হন। তাহলে সম্পার মায়ের মত আর কোন মাকে চোখের পানিতে ভাসতে হবে না। পারভেজের মত আর কোন ভায়ের মুখের হাসি চিরতরে বিদায় নেবেনা। শুধু বিদায় নেবে খবরের কাগজের পাতা থেকে সড়ক দুর্ঘটনা। আর সেটাই আমাদের প্রতাশা।
মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান খান।
ওসাকা, জাপান।
dipukhan@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন